প্রকাশিত: Sat, Jun 8, 2024 2:55 PM
আপডেট: Tue, Apr 29, 2025 11:40 PM

ধনাগানো প্রদেশে রবীন্দ্রনাথ

প্রবীর বিকাশ সরকার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মারক ভাস্কর্য রয়েছে জাপানের দুটি প্রদেশে। একটি নাগানো-প্রদেশে অন্যটি টোকিওতে। প্রথম স্থাপিত হয়েছে নাগানো-প্রদেশের কারুইজাওয়া শহরের সন্নিকটে আসামা পাহাড়ের পাদদেশে। সম্ভবত আশির দশকে, সালটি মনে পড়ছে না। কারুইজাওয়া খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা হিসেবে খ্যাত। মেইজি যুগে একে শহরে রূপান্তরিত করা হয়। একসময় অনেক আমারিকান, ব্রিটিশ নাগরিক বসবাস করতেন। 

পাশ্চাত্যধারায় আধুনিক করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের অবদান অনেক। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এখানে ধনীদের গ্রীষ্মাবাস নির্মাণের জন্য জনপ্রিয় লক্ষ্যে পরিণত হয়। আমার শ্বশুরবাড়ি এই নাগানো-প্রদেশে। ভাবতেই আনন্দ হয় যে, রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে প্রথম জাপান ভ্রমণের সময় নাগানো-প্রদেশে এসেছিলেন এবং কয়েকদিন অবস্থান করেছিলেন। জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি শাখায় বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রি হয়েছিলেন এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য অধ্যাপক ডঃ নারুসে জিনজোও কর্তৃক। আমার রচিত ‘বীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ গ্রন্থে বিস্তারিত আছে। ২০০২ সাল ছিল জাপান-বাংলা অঞ্চলের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়ের ১০০তম পূর্তি। যার সূচনা হয়েছিল ১৯০২ সালে কলিকাতায় জাপানি মনীষী, শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিন ও রবীন্দ্রনাথের যৌথ পৌরহিত্যে। উক্ত ঘটনাকে স্মরণ করে আমি আমার জাপানি রবীন্দ্রভক্ত বান্ধবী ওওবা তামিকোকে অনুরোধ করি একটা কিছু করা যায় কিনা। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। 

আমরা জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমাকে উপদেষ্টা করে একটি ‘জাপান-বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি অস্থায়ী সংগঠন দাঁড় করি ২০০০ সালে। তারপর ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে জনা ৫০ রবীন্দ্রভক্তকে জড়ো করে আলাপ-আলোচনায় কয়েকটি পরিকল্পনা হাতে নিই। তার একটি ছিল ‘রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত স্থান ভ্রমণ’ পরিকল্পনা। ৩০ জন মিলে একটি মাঝারি বাস ভাড়া করে প্রথমেই যাই নাগানো-প্রদেশের কারুইজাওয়া শহরে। একটি বড় রেস্টুরেন্টে একটি সভা করি। আমি প্রধান বক্তা হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ও মাদাম ডঃ কোওরা তোমি সম্পর্ক নিয়ে কথা বলি মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনে। আমাদের সৌভাগ্য দুজন সম্মানিত রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন আমাদের সঙ্গে। একজন জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকির পৌত্রী স্বনামধন্য পরিবেশবাদী নেত্রী, রাজনীতিবিদ এবং ইতিহাস গবেষক। অন্যজন, প্রাক্তন জাপান আইবিএম প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ এবং ইতিহাস গবেষক ওওৎসুকা তোশিআকি স্যার। 

আলোচনা শেষ করে যাই নয়নাভিরাম সবুজবীথির অমরাবতী মাউন্ট আসামার পাদদেশে যেখানে পাহাড়ের শীর্ষচূড়ার দিকে তাকিয়ে আছেন প্রকৃতি ও মানবপ্রেমী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার এই স্মারক ভাস্কর্যটি প্রতিষ্ঠা করেছেন মনস্তত্ত্ববিদ অধ্যাপিকা স্বনামধন্য রবীন্দ্রভক্ত ডঃ কোওরা তোমি। কবিগুরুর সঙ্গে এই নাগানো-প্রদেশে তার সাক্ষাৎ এবং গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যা মৃত্যু পর্যন্ত বজায় ছিল। সাক্ষাৎকালে তোমি ছিলেন জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কবিগুরু চেয়ে ৩৫ বছরের ছোট ছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে অন্যরকম এক মানবিক সম্পর্ক ছিল। একদিনের জন্যও গুরুদেবকে বিস্মৃত হননি মাদাম কোওরা তোমি। গুরুদেবের শান্তির বাণী সারাজীবন জাপানে প্রচার করেছেন। তাদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মাদাম কোওরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীসহ আর্থিক সাহায্যে এই স্মারক ভাস্কর্যটি নির্মাণ ও স্থাপন করেন। রবীন্দ্র-কোওরা সম্পর্ক জাপানে একটি অপ্রচারিত, অজানা অধ্যায়। বাঙালি হিসেবে এই সম্পর্ক নিয়ে আমি প্রথম প্রবন্ধ লিখি ২০০৯ সালে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ২০০০-এর ঈদ সংখ্যায়।  জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক